সিজারিয়ান: এক পঙ্গুত্ব! (Cesarean : Suffering for whole life)
প্রাচীনকালে দাদী-নানী, মা-খালাদের গণ্ডা গণ্ডা বাচ্চা হত। স্বাভাবিক নিয়মেই এসকল বাচ্চা পৃথিবীর মুখ দেখত। তবে বর্তমানে বাচ্চা হবার ক্ষেত্রে খুব পরিচিত একটি শব্দ হচ্ছে সিজারিয়ান। স্বাভাবিক নিয়মে বাচ্চা হওয়া এখন প্রায় অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। সিজার করা হয় প্রসব জটিলতা এড়াতে। যার, স্বাস্থ্যে ঝুঁকি প্রচুর। কিন্তু , তা সত্ত্বেও বর্তমানে সিজার এক মহামারী আকার ধারণ করেছে।
কেন করা হয় সিজার (Why Cesarean) :
আরো পড়ুন> বিকাশ অ্যাাপ দিয়ে ঘরে বসেই আয় করুন ৩০ -৮০ হাজার টাকা।টীপস সহ।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রসব জটিলতা এড়াতে বা শিশু ও মায়ের জীবন বাচাতে সিজার অপারেশনের মাধ্যমে বাচ্চার জন্ম দান করা হয়। যেমন- স্বাভাবিকের চাইতে প্রসব বেদনা যদি দীর্ঘ হয় , প্লাসেন্টা বা গর্ভ ফুল যদি আশংকা জনক হাড়ে জরায়ু মুখের কাছে নেমে আসে, মাতৃগর্ভে যদি শিশুর অবস্থান অস্বাভাবিক হয় অথবা প্রসবের পূর্বেই যদি নারী জরায়ুর বাইরে বেড়িয়ে আসে। এছাড়াও গর্ভবতী মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ,ডিম্বাশয় ও জরায়ুর সিস্ট, টিউমার থাকলে সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা জন্ম দেওয়া হয়।
অর্থাৎ , মা বা শিশুর অবস্থা যদি এমন পর্যায়ের শোচনীয় হয় যে স্বাভাবিক নিয়মে বাচ্চা প্রসব করালে বড় ক্ষতি হতে পারে বা মৃত্যু ঘটতে পারে একমাত্র সে অবস্থায় সিজার করা যেতে পারে ।
সিজারের কুফল (Harms of Cesarean):
কিন্তু বর্তমানে প্রয়োজন ছাড়াই করা হয় প্রচুর সিজার অপারেশন। আর এর কুফলও অনেক। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হয় সিজারের কারণে বাচ্চা মৃত্যু হার কমে গিয়েছে, কিন্তু কৃত্রিম কোন কিছুই মানুষ জাতির জন্য ভালো নয়। বরং গবেষণায় উঠে এসেছে সিজারের কারণে নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। যেমন-
১। ২০০৭ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল একটি জরিপ পরিচালনা করে। বিভিন্ন হাসপাতালের উপর পরিচালিত এই জরিপে উঠে এসেছে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান করা মায়েদের মৃত্যু ঝুঁকি তিন গুণ বেশি। স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে যেখানে মৃত্যু ঝুঁকি ০.১%, সেখানে সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে মৃত্যু ঝুকি০.৪%। গবেষক দের মতে যেহেতু সিজারিয়ান একটি মেজর অপারেশন সেজন্য এর স্বাস্থ্য ঝুঁকিও অনেক বেশি। নরমাল ডেলিভারিতে বাচ্চা মৃত্যুর হার বেশি মনে হলেও, বরং সিজারে বাচ্চা মৃত্যুর হার বেশি। বিশেষ করে কম ওজনের বাচ্চাদের মৃত্যু ঝুঁকি আরও বেশি।
২। সিজারের কারণে জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। সিজারিয়ানের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া বাচ্চার জন্ম পরবর্তী শ্বাস –প্রশ্বাস জনিত জটিলতা বেশি পরিলক্ষিত হয়। কারণ স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে শিশুর ফুসফুস থেকে কিছু তরল নিঃসৃত হয়, যা মাতৃগর্ভের বাইরে এসে স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য শিশুর ফুসফুস কে প্রস্তুত করে। সিজারে অপারেশন হলে এই প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত হয়।
৩। এছাড়া, বাচ্চা প্রসব প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করার জন্য ‘পিটো সিন’ নামে এক ধরনের ওষুধ ব্যবহারে চল রয়েছে, যা প্রসূতির জরায়ুতে সংকোচন সৃষ্টি করে। এই সংকোচন এক প্রকার ব্যথার সৃষ্টি করে । এজন্য আবার দেওয়া হয় ব্যথানাশক ওষুধ। এই ওষুধ জরায়ুর সংকোচন কে বিলম্বিত করে। যা গর্ভস্থ শিশুর ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়।
৪।যেহেতু সিজার একটি মেজর অপারেশন। এর ফলে মায়ের অনেক গুলো সেলাই পড়ে। এজন্য একবার সিজার হবার পর পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে একজন মাকে বাচ্চা নিতে নিষেধ করা হয় । কারণ বাচ্চা ধারন করলে তা সেলাই অংশে মারাত্মক ক্ষতি করে। এরপরও অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কোন মা যদি বাচ্চা ধারণ করে ফেলে তবে মা ও শিশু থাকেন প্রচণ্ড স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। এছাড়া সিজার করা মায়েরা ৩ বারের বেশি বাচ্চাও নিতে পারে না।
৫। সিজার পরবর্তী সন্তান বুকের দুধ পায় অনেক দেরিতে। ফলে , মা ও শিশু দুজনকেই অনেক কষ্টকর সময় পার করতে হয়।
৬। এছাড়া সিজারিয়ানের ফলে যে এনেসথেসিয়া দেওয়া হয় তার প্রভাবে নারীদের স্থায়ী কোমর ব্যথার সমস্যা দেখা দেয়। যাকে একটি স্থায়ী পঙ্গুত্বের সাথে তুলনা করা যায়।
৭। গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে সিজার করা মায়েরা পোস্ট প্রেগনেন্সি ডিপ্রেশন এ বেশি ভুগে। অর্থাৎ, বাচ্চা হবার পর মায়েদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে এক ধরনের ডিপ্রেশন কাজ করে। সে অবস্থায় সিজারের কারণে শারীরিক কষ্ট এবং সন্তানের দুধ না পাওয়া নতুন মায়ের ডিপ্রেশন অনেক বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় তা স্থায়ী মানসিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়।
তারপরেও কেন সিজার করা হয়?
এখন প্রশ্ন হতে পারে এত সমস্যা থাকার পর ও কেন ডাক্তাররা এখন সিজার এর পরামর্শ বেশি দিয়ে থাকেন-
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মায়েদের জটিলতা দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে আসলেই মা ও শিশুর জীবন বাঁচানর জন্য সিজার করা জরুরি হয়ে পড়ে। তবে গবেষণায় উঠে এসেছে শতকরা ৯০ ভাগ সিজার করা হয় অপ্রয়োজনীয় কারণে। আর এখানে একটি বড় কারণ হচ্ছে টাকা। জরিপে দেখা গিয়েছে আমাদের দেশে যতগুলো সিজার হয় তার ২৩% সিজার হয় স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলোতে আর বাকি ৭৭% সিজার হয় বেসরকারি হাসপাতাল গুলোতে। এছাড়া জানা যায় , অনেক বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার দের উপর চাপ প্রয়োগ করা হয় সিজার বেশি করে করানর জন্য । এমনকি সিজারের পরিমাণ বেশি না হলে চাকরি চলে যাবার ভয় ও দেখান হয়। কারণ নরমাল ডেলিভারিতে বেসরকারি হাসপাতাল গুলো তেমন লাভ করতে পারে না। সেখানে সিজার করাতে পারলে লাভ তিন গুণ বেশি।
এছাড়া একটা নরমাল ডেলিভারিতে ডাক্তারকে অপেক্ষা করতে হয় অনেক বেশি। সেটি দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত ও হতে পারে । আর সেই একই সময়ে একজন ডাক্তার ৪-৫ টা সিজার করে ফেলতে পারে। আবার, নরমাল ডেলিভারিতে ডাক্তার টাকাও পায় কম। সেখানে , সিজার হলে টাকার পরিমাণ হয় তিন গুন বেশি।
সিজার হলে হাসপাতালে থাকতে হয় প্রায় ৭ দিন, যেখানে নরমাল ডেলিভারিতে বাচ্চা জন্ম দানের পর দিনই মা বাসায় চলে যেতে পারেন। ফলে ক্লিনিক গুলো আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
হয়।
তবে শুধু মাত্র ডাক্তারের দোষ দিলেই হবে না। অনেক সময় রোগীর স্বজনেরা ডাক্তারের উপর চাপ প্রয়োগ করে সিজারের জন্য। কারণ মানুষের মধ্যে ও এরকম একটা ধারনা ঢুকে গিয়েছে যে সিজার করাটাই বোধয় বেশি নিরাপদ। মানুষও এখন লম্বা সময় প্রসব বেদনার ধইর্য রাখতে পারে না। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না যে , তাদের একটু ধইর্য হীনতা গর্ভবতী মাকে সারাজীবনের পঙ্গুত্ব দান করছে।
সুতরাং, ডেলিভারির লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয় না , এটা ছাড়া সিজারের আর কোন উপকারিতা তো নেই, বরং মা শিশুর জন্য তা খুবই ক্ষতিকর। আপনি যদি হলিউড –বলিউডের নায়িকাদের বাচ্চা হবার ইতিহাস দেখেন ,তবে দেখতে পাবেন তারা সবাই নরমাল পদ্ধতিতে বাচ্চা নেয়। সিজার একদম করে না বললেই চলে। কারণ তারা জানে সিজার তাদের ফিগার ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পরবর্তীতে আবার মিডিয়াতে আসতে তাদের ফিগার ধরে রাখতে চাইলে নরমাল ডেলিভারি প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে হলিউড নায়িকা এঞ্জেলিনা জোলিকে দেখতে পারেন। তিনটি বাচ্চা জন্মদানের পর ও সে কি পরিমাণ ফিট আছে। তার তিনটা বাচ্চা কিন্তু
নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে হয়েছে।
সুস্থ মা শিশুর জন্য এখনি সচেতনতা প্রয়োজন। সিজার নামের এই পঙ্গুত্ব থেকে নারীকে রক্ষা করতে হবে। সচেতনতাই পারে এই মহামারি রোধ করতে।
সুতরাং, নিজে সচেতন হওন, অন্যকে সচেতন করুন।
No comments