কোর্ট ম্যারিজ কি বৈধ? নারীদের জানা জরুরী!
আমাদের দেশে কোর্ট ম্যারিজ শব্দটি বহুল প্রচলিত। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের এ সম্পর্কে সঠিক কোন ধারনা নেই। বরং কোর্ট ম্যারিজের মাধ্যমে অনেকেই প্রতারিত হচ্ছেন বিশেষ করে নারীরা। বাংলাদেশের আইন অনুসারে এই কোর্ট ম্যারিজ আসলে কতটুকু বৈধ?
এ সম্পর্কে বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা হল-
কোর্ট ম্যারিজ বলতে কি বোঝায় ?
হলফ-নামার মাধ্যমে বিয়ের একটা ঘোষণা দেওয়াকেই বলা হয় কোর্ট ম্যারিজ। এক শ্রেণীর নোটারী পাবলিক বা উকিলের মাধ্যমে হলফ নামা তৈরি করে এই বিয়ের ঘোষণা দেয়া হয়।এর মধ্যে দেন মোহর, স্বামী স্ত্রীর অধিকার, সাক্ষী সম্পর্কে কোন তথ্য উল্লেখ থাকে না।
অনেকের মধ্যে কোর্ট ম্যারিজ করার প্রবণতা বেশি।অনেক সাধারণ মানুষ মনে করে যে কোর্ট ম্যারিজের মাধ্যমে বিয়ে করলে বিয়ের বন্ধন শক্ত হবে।
আইনে কি বলা হয়েছে?
বাংলাদেশের আইন অনুসারে কোর্ট ম্যারিজের কোন বৈধতা নেই। এ ধরনের বিয়ে দেশীয় বা ধর্মীয় আইনের শর্ত পুরন করে না। সুতরাং,
এই ধরনের বিয়েকে আসলে কোন বিয়েই বলা যাবে না। আইনের ছদ্মবেশে এক শ্রেণীর নোটারী পাবলিক এই অবৈধ কাজে সহযোগিতা করে। অনেকেই এই ধরনের কোর্ট ম্যারিজের জন্য উকিলের কাছে যায়। কিছু উকিল টাকার লোভে সাহায্য প্রার্থীদের আসল আইনটা জানান না। শুধু মাত্র একটি হলফ নামায় বিয়ের ঘোষণা দেন।
আইন অনুসারে বিয়ে তখনই বৈধ হবে যখন বিয়ে কাবিন রেজিস্ট্রি করা হবে। এই বিয়ে রেজিস্ট্রি করবে সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কাজি নিকাহ রেজিস্ট্রার দ্বারা। কাজি বাসায় ডেকে এনে অথবা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ের রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করতে হবে। আইন অনুযায়ী কাবিন রেজিস্ট্রি ও আকদ সম্পন্ন করেই একমাত্র ঘোষণার জন্য এফিডেভিট করা যাবে।
আইন অনুযায়ী বিয়ের আসরেই কাবিন রেজিস্ট্রি করতে হয়। বিয়ের আসরে সম্ভব না হলে বিয়ে হবার ১৫ দিনের মধ্যেই বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
মুসলিম বিবাহ ও বিচ্ছেদ বিধি ১৯৭৫ এর ১৯(৩) ধারা অনুযায়ী নিকাহ রেজিস্টার ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি যদি বিবাহ পড়ান, তবে সেই ব্যক্তিকে ১৫ দিনের মধ্যে অত্র এলাকার নিকাহ রেজিস্টারের নিকট অবহিত করতে হবে।
আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী বিয়ে রেজিস্ট্রেশন না করা কিন্তু একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৯৭৪ এর ধারা ৫(২) অনুযায়ী বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না করার শাস্তি সর্বোচ্চ (তিন) মাসের কারাদণ্ড,
অথবা ৫০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবার বিধান রয়েছ।
নারীরা কিভাবে প্রতারিত হয়?
সাধারণত প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করে কাজি অফিসে বিয়ের জন্য একটা বড় অংকের ফিস দিতে হয়। সেটা থেকে বাচার জন্য অনেকে কোর্ট ম্যারিজ করে। আবার যাদের মধ্যে অসৎ উদ্দেশ্য থাকে তারাও এই পথটি বেছে নেয়। কারণ, রেজিস্ট্রির মাধ্যমে যে বিয়ে হয় সেটাতে কিছু নিয়ম থাকে। সরকারি ভাবে সে বিয়ে আইনত স্বীকৃতি পায়। রেজিস্ট্রিতে নারীদের বিভিন্ন অধিকার যেমন দেন মোহর, তালাকের অধিকার, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার উল্লেখ থাকে । এছাড়া রেজিস্ট্রি করে বিয়েতে অবশ্যই সাক্ষী থাকতে হয়। কিন্তু,কোর্ট ম্যারিজ নামক বিয়েতে সাক্ষী প্রয়োজন হয় না। ফলে, নারীদের কে প্রতারিত করা এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত করা অনেক সহজ হয়।
এধরনের কোর্ট ম্যারিজের মাধ্যমে নারীদের প্রতারিত করার কিছু কৌশল নিচে বর্ণনা করা হল-
- আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী দ্বিতীয় বিয়ে করতে হলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়। অনেকেই বিয়ের কথা গোপন রেখে আরেকটা বিয়ে করার জন্য এ ধরনের কোর্ট ম্যারিজের আশ্রয় নেয়।
- অনেক প্রতারক আবার নারীর অভিভাবকদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এ ধরনের বিয়ে করে। পরবর্তীতে, বিয়ে অস্বীকার করে। তখন নারীর পক্ষে বিয়েটি প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায়। এছাড়া দেন মোহর উল্লেখ থাকে না বিধায় নারীরা তাদের প্রাপ্য দেন মোহর থেকে বঞ্চিত হয়।
- কিছু প্রতারক নারীকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কোর্ট ম্যারিজ করে শারীরিক সম্পর্ক করে। কিন্ত কোর্ট ম্যারিজ যেহেতু আইনত স্বীকৃত নয়,সেহেতু নারীর পক্ষে এই বিয়ে প্রমাণ করা কষ্টকর হয়ে যায়। অনেক সময় সন্তানের পিতৃ-পরিচয় অস্বীকার করে পুরুষ। তখন পিতৃত্ব প্রমাণ ও বাবার অধিকার আদায় কঠিন হয়ে যায়। অনেক সময় সাক্ষী না থাকায় বিয়ে প্রমাণ ও করতে পারে না। আর ছেলে পক্ষ যদি প্রভাবশালী হয় সেক্ষেত্রে মেয়েটার পক্ষে বিয়ে প্রমাণ করা আরও কষ্টকর হয়ে যায়।
- অনেকে এই সুযোগে নারীকে বা নারীর পরিবার কে সামাজিক ভাবে হেয় করে। জিম্মি করে টাকা আদায়ের ঘটনাও দেখা যায়।
- এই দলিল করা খুবই সহজ। অনেক সময় হলফ-নামা প্রার্থী কে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন হয় না। ফলে ১৮ বছরের নিচে অর্থাৎ দেশিও আইনে নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়। আবার নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা থেকে বাচার জন্য ও অনেকে কোর্ট ম্যারিজ করে।
- যেহেতু সরকারী কোন কাজী উপস্থিত থাকে না , সেহেতু অনেক সময় বিয়ে বাতিল করার জন্য ছেলে পক্ষ এই কারণ দেখায় যে মেয়ে পক্ষ জোর করে দলিলে স্বাক্ষর নিয়েছে।
কাবিন নিবন্ধন করা থাকলে সুবিধা কি?
যদিও কাজীর কাছে বিয়ে নিবন্ধন করতে কিছু খরচ হয়, তবুও নিবন্ধন করাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ বিয়ে নিবন্ধনের কিছু সুবিধা রয়েছে-
১। বিয়ে নিবন্ধন করা থাকলে তালাকের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা সহজ হয়। তখন মেয়েটা সহজেই তার নিজের, সন্তানের খোরপোষ দাবি করতে পারবে।
২। স্ত্রীর দেনমোহর ও ভরণপোষণ আদায়ের জন্য কাবিননামার প্রয়োজন হয়।
৩।সন্তানের বৈধ পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য কাবিননামার প্রয়োজন হয়।
৪। কাবিননামা ছাড়া শুধু বিয়ের হলফ-নামা সম্পন্ন করা হলে বৈবাহিক অধিকার আদায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
সুতরাং,
কোর্ট ম্যারিজ শব্দটি মুখে মুখে বহুল প্রচলিত হলেও আসলে বাংলাদেশের আইনে এই বিয়ের কোন ভিত্তি নেই। এজন্য আবেগের বশবর্তী হয়ে, বা ঝামেলা এড়ানোর জন্য কখনই এর দ্বারস্থ হবেন না। তাহলে খুব সহজেই হতে পারেন প্রতারণার স্বীকার । নারীদের এক্ষেত্রে বিশেষ সাবধান থাকতে হবে।
বিয়ে অবশ্যই কাবিন রেজিস্ট্রি করুন। নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকুন। ভালো থাকুন।
No comments